মজনু মোস্তাফা

আমি অভিমানে গুমরিয়ে উঠি। কলকাতা থেকে একশো কিলোমিটার দূর কৃষ্ণনগরে বসে লিখেছিলেন যিনি, তিনি নির্মাল্যভূষণ ভট্টাচার্য ওরফে মজনু মোস্তাফা। এই অভিমানই বস্তুত তাঁকে নির্মাল্যভূষণ থেকে করেছিল মজনু মোস্তাফা।
ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্রবের সূত্রে করতে হয়েছিল কারাবাস। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত দমদম প্রেসিডেন্সি জেলে থাকার সময়েই তাঁর কাব্যচর্চা গতি পায়।১৯৫১-র পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যান। হয়তো আপসকামী খন্ডিত স্বাধীনতা ও তদপরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের উচ্চাবচ তরঙ্গনিচয়ে পাক খাওয়া সময়ে, স্বপ্ন ও বিশ্বাসভঙ্গের বেদনার ঘূর্ণাবর্তে আস্থায় স্থির থাকা সম্ভব হয়নি কবি নির্মাল্যের পক্ষে। কিংবা হয়তো তাঁর অনুভূতিমালাকে, স্বপ্ন বা ধ্যানের জগৎকে যত্ন করবার মতো যথেষ্ট সময় আমাদের হাতে ছিল না। তাই তীব্রতম সংবেদনের ছিটমহলে আজীবন তাঁকে দাঁডিয়ে থাকতে দেখা যায়।
যে শহরে মজনু জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন, সেই কৃষ্ণনগর এমন এক শহর, যা খুব কাছ থেকে খাদ্য আন্দোলন দেখেছে। ছুরি, গুলি, অজ্ঞাতবাস, অত্যাচারের গল্প ভেসে বেড়াত শহরের বাতাসে, তার মধ্যেও একগুচ্ছ নাট্যদল প্রবল উৎসাহে লড়ে যেত, সযত্নলালিত পত্রিকার পর পত্রিকার পর পত্রিকা বের হয়, কবিতা নিয়ে প্রখর আকচাআকচি হতে থাকে বিশেষ বিশেষ চায়ের দোকানে, রকের আড্ডায়।অবিসংবাদিতভাবে এইসব আড্ডার অধিকাংশেরই মধ্যমণি ছিলেন নির্মাল্যভূষণ ওরফে মজনু মোস্তাফা। সেই অস্থিরতার শহরেও উড়ে বেড়াত মজনুর লেখা বিস্ফোরক সব পঙক্তি।
অন্যান্য যে কোনো মহৎ রচকের মতো মজনু সময়সচেতন তো বটেই, উপরন্তু ইতিহাসের অন্তর্বস্তু বিষয়ে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। লিখেওছিলেন : আমি একচোখে দেখি না শুধু ইতিহাস। ফলে প্রকৃত প্রস্তাবে মজনু ছিলেন নিজেরই মতো, আদ্যন্ত স্বতন্ত্র। আর এ জন্যই তাঁর কবিতা মনোযোগী পাঠকের সমীপে পৌঁছোনো জরুরি।
জীবৎকালে প্রকাশিত মজনুর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘উনিশ যন্ত্রণা’র ভূমিকায় ‘লা পয়েজি’ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক বার্ণিক রায় মজনুকে ফরাসি কবি রাঁবো’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এছাড়া মজনুর কবিতা, নিজস্ব প্রিয়তা ও তাঁর কবিতার অয়নচক্রে যাঁদের নাম এসে পড়ে, সেই পল্ এল্যুয়ার, গর্সিয়া লরকা, মায়াকাভস্কি প্রমুখের সঙ্গে বস্তুত মজনুর ছিল যুগ ও যুগস্বভাবের সখ্য। লক্ষণীয় যে, এঁরা সকলেই দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালের পৃথিবীর চিন্তন ও মননের ভাষ্য রচনা করেছেন। অন্যদিকে মজনু স্বাধীনতা পরবর্তী ব্যবচ্ছেদদীর্ণ স্বপ্ন ও বিশ্বাসভঙ্গের প্রতিবেশে প্রাপ্তমনস্কতা অর্জন করেছিলেন।
তেমন অতন্দ্র সংবেদন আছে যাঁর, তাঁর দাহ তো চিরকাল—চিরকাল নিষেধরেখার দু পাড়ে তাঁর চলাচল…তিনি কবি মজনু।

Showing the single result