সমর ভট্টাচার্য

অনতি-বাল্যকালেই তাঁদের পরিবার এপার বঙ্গে চলে এলেও সমর তাঁর সত্তা-বিজড়িত মেহেরপুরের অপরিণত স্মৃতি আজীবন বহন করেছেন। উচ্ছিন্ন নিরুপায়তায় ছেড়ে আসা সেই ভূ-বিশ্ব, ভৈরবের পাড়ের সেই গ্রামীণ অথচ প্রাচীন মেহেরপুরের নিসর্গ ও মানবসঙ্গের স্পর্শকে কখনও পেছনে ফেলে যেতে পারেননি সমর— না জীবনযাপনে, না নিজের সৃজন-বিশ্বে!
যে দারিদ্র্য, অর্থাভাব অনতি-কৈশোর থেকেই সমরের জীবনের মূল অভিজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা কিন্তু ছিল তাঁর শৈশবের বিপরীত যাত্রা। মেহেরপুরে থাকতে সংসারে প্রাচুর্য না থাকলেও খাওয়া-পরার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা, বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীদের স্নেহ ইত্যাদিতে ঘাটতি ছিল না। কিন্তু শৈশবের সুখযাত্রা ছিল নিতান্তই স্বল্পস্থায়ী।
বিভাগোত্তোরকালে সমরদের পরিবার দারিদ্র্যে নিক্ষিপ্ত হয়। কৈশোরে পা দেবার আগেই সংসারযাত্রা নির্বাহের পাঠ নিতে হয় তাঁকে। কখনও ফৌজদারি আদালতের মোক্তারবাবুর মুহুরির সহকারী, কখনও সাইকেল সারাইয়ের দোকানের কর্মী, কখনও সরকারি অফিসের নৈশপ্রহরীর কাজ— দু মুঠো অন্নের জন্য কত কিছুই করতে হয়েছে সমরকে। সম্ভবত সেই প্রথম জীবনের জীবিকানির্বাহের বিপন্নতা ও অনিশ্চিতির টলমল সময় থেকেই তিনি স্বাস্থ্যহানির শিকার হতে থাকেন।
আমৃত্যু (প্রয়াণ : ২০০২ সাল) ক্ষীণস্বাস্থ্য ও শ্রমনাশা শরীরী বেদনা থেকে তিনি রেহাই পাননি। বরং পরবর্তীকালে পেশাগত কারণে অসুস্থতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
শরীর-স্বাস্থ্যের দুর্গতি, পরিবেশের প্রতিকূলতার কারণে তাঁর রচনার পাণ্ডুলিপি তো বটেই– মুদ্রিত কপি পাওয়াও সহজ নয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গৃহিণীপনার অভাব। স্ত্রীর অকালপ্রয়াণের পর সমরের সংসারযাত্রাই হয়ে পড়েছিল অনিয়মিত, অসংগঠিত— সন্তানেরা ছিল নাবালক— জীবন-সংরক্ষণের ব্যবস্থাই হয়ে পড়েছিল নড়বড়ে— তো মুদ্রিত রচনা আর পাণ্ডুলিপি!
তবু সমর থাকেন, তাঁকে ধরে রাখতে হয় গলার চারণের সুরটিকেও, তাঁর ভেতরে বেঁচে থাকে আজন্ম-কিশোরটি। এক দেশ থেকে অন্য দেশে নদীপথে পৌঁছোনোর সময় নৌকায়-বসা কিশোরটির চোখ দিয়ে বেঁচে থাকেন সমর—
“নগেন পাটনি নৌকোর কাছি খুলে দাঁড় হাতে গলুইয়ে বসে কারও উদ্দেশে প্রণাম করে যাত্রা শুরু করল।
এখন বর্ষাকাল হলেও বর্ষার শেষপর্ব। গমনের সময় উপস্থিত। শরৎ আসছে আসছে ভাব। নদীর দু-কূলে সাদা বকের ডানার মতন কাশফুলের ইশারা। তারই মধ্যে ধূসর আকাশে ফকিরি আলখাল্লার মতো সবুজ-নীল তালি। আওলা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশময়। কখনও-বা বৃষ্টি হতে হতে চলে যাচ্ছে। কখনও-বা নদীর এপারে বৃষ্টি, ওপার শুষ্ক।
অংশু অবাক হয়ে দেখে। স্রোতের পক্ষে নৌকা তরতরিয়ে ছুটছে। হাওয়াটা পক্ষে বলে ছৈ-এর ওপর বাঁশের দণ্ডে পাল টাঙিয়েছে নগেন পাটনি। হাওয়া পেয়ে পাল ফুলে উঠেছে।
নৌকো ছুটছে পক্ষীরাজের মতন। দু-গলুইয়ে দুজন পাটনি হাল ধরে স্থির বসা। পেরিয়ে যাচ্ছে গ্রাম। নদীর দু-কূল দু-রকম। এক কূল উঁচু পাউরি, অন্যকূল সমান্তরাল। এখন জলময়। অন্য সময় অংশু দেখেছে হা-হা করা বিস্তীর্ণ বালুচর। পাউরির ফাঁকফোকরে মাছ-শিকারী পাখপাখালির বাসা– মাছরাঙা, শঙ্খচিলের ওড়াউড়ি।”

Showing the single result