আত্মকেন্দ্রিক অথচ আত্মবোধ ও ‘আত্মদীপ’-শূন্য সাম্প্রতিক বিভ্রমের মধ্যেও প্রথমত এবং শেষত একটা কথা বলা খুব জরুরি যে, আত্মঘোষণায় আমাদের বিশ্বাস নেই। তবু সুপ্রকাশ-এর লক্ষ্যটিকে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শনের পত্রসূচনা’র মতো করে জানিয়ে রাখা ভালো। তাতে আাত্মপক্ষ সমর্থনের গ্লানি থাকলেও কৈফিয়ৎ দেওয়ার প্রয়াস এ কারণেই করা গেল যে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতার প্রশ্নে এ ধরণের কথনের কিছু মূল্য থাকলেও থাকতে পারে।

যদিও সুপ্রকাশ প্রকাশনা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে ২০১৮ সালের কলকাতা বইমেলায় থেকে বলেই আমাদের কাছের বন্ধুরা জানেন,(আমাদের চারটি বই এই বইমেলাতে প্রকাশিত হয়), কিন্তু সুপ্রকাশ আদৌ নতুন প্রকাশনা নয়। বিগত শতকের নয়ের দশকে, ১৯৯০তে—‘কথাচিত্রকর দীনেন্দ্রকুমার রায়’ বইটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে সুপ্রকাশ শুরু হয়েছিল।

তারও আগে ছিল সলতে পাকানোর ইতিহাস। সে গল্পে যেতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে সাতের দশকে মেট্রোপলিটন কলকাতা থেকে একশো কিলোমিটার দূরে এক মফস্বল শহরে। একদিকে ভেঙে পড়া সামন্ততান্ত্রিক অভিজাত্য, অন্যদিকে ওপার বাংলা থেকে সব হারিয়ে আসা উদ্বাস্তু-জীবন ও রাজনৈতিক জীবনের অস্থিরতা ভেতরে নিয়ে তখন এক বিচিত্র বৈপরীত্যের জনপদ মফস্বল শহরগুলি। একদিকে খাদ্য আন্দোলনের উত্তাপ ছুঁয়ে থাকা শহরের বাতাসে ছুরি,গুলি, বোমা অজ্ঞাতবাসের গল্প ভেসে বেড়ায় , অন্যদিকে সন্ধে-ছোঁয়া বিকেলে পাড়ায় পাড়ায় কান পাতলেই শোনা যায়, ‘আয় তবে সহচরী’ কিংবা ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায়’। অনেক না-থাকার মধ্যেও একটা বিরাট অস্তিত্বের অভিমান ছিল গোটা শহর জুড়ে, বিশেষত তরুণদের মধ্যে। যার ফলে একদল ছেলে অবিরত ‘লড়ে যায়’।— একগুচ্ছ নাটকের দল নিয়মিত কাজ করে চলে, বের হতে থাকে পত্রিকার পর পত্রিকা, স্থানীয় সংবাদপত্রগুলি জাগিয়ে রাখে কৌতূহল, একেবারেই তরুণদের নিজস্ব শক্তিতে আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক উৎসব। এখানেই  আটের দশকের শুরুতে জন্ম নিয়েছিল প্রতিভাস পত্রিকা(পরে নাম পরিবর্তন করে হয় আজকের প্রতিভাস), পরে সেই পত্রিকারই প্রকাশনা, সুপ্রকাশ। ১৯৯০-১৯৯৭ কালপর্বে সুপ্রকাশ গণনীয় সংখ্যক গ্রন্থ ও পুস্তিকা প্রকাশ করতে পেরেছিল

সু্প্রকাশ নামটা রেখে  ২০১৭ সালে যখন নতুনভাবে প্রকাশনার কাজ শুরু হয়, তখন আমরা নামের সঙ্গে সঙ্গে পূর্বতন সুপ্রকাশের উদ্দেশ্য-বিধেয়কেও মনে রেখেছিলাম। এই পর্যায়ে আমাদের প্রথম প্রকাশনা ‘মজনু মোস্তাফা কবিতা সংগ্রহ’। মজনু মোস্তাফা—ছদ্মনামের আড়ালে থাকা নির্মাল্যভূষণ ভট্টাচার্য সেই আশ্চর্য গোত্রের কবি, স্বল্পপঠিত হলেও যাঁর কবিতার ভরবেগ প্রচণ্ড। আজীবন কবিদের, তরুণ লেখকদের স্বজন ছিলেন, লালন করেছিলেন ক্ষীণতনু পত্র-পত্রিকার যাবতীয় উদ্যোগকে। ১৯৮০ তে অকালপ্রয়াণের পরে একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছিল—‘উনিশ যন্ত্রণা’। মৃত্যুর পরে ‘মজনু মোস্তাফার কাব্যগ্রন্থ’। সেই কাব্যগ্রন্থ ও তাঁর ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য কবিতা নিয়ে ‘মজনু মোস্তাফা কবিতা সংগ্রহ’ প্রকাশ করে সংস্কৃতিকর্মীর প্রজন্মান্তরের দায় পালন করেছে সুপ্রকাশ।

এই বইটির সঙ্গেই প্রকাশিত হয়, ‘সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ’। সাহিত্যক্ষেত্রে প্রায় অচর্চিত সমর ভট্টাচার্য জন্মেছিলেন অবিভক্ত নদীয়ার মেহেরপুরে।দেশবিভাগের ধাক্কায় এপার বাংলায় এসেও  শৈশবের ফেলে আসা মেহেরপুরের স্মৃতিকে সমর নিজের সৃজনবিশ্বে কখনও ছেড়ে যেতে পারেননি,—দেশবিভাগের ক্ষত এক জন্মে কেই বা ভুলতে পেরেছিলেন! আজীবন ছিলেন ক্ষীণতনু। নাবালক ছেলেমেয়ে নিয়ে হারিয়েছিলেন স্ত্রীকে। শ্রমনিষিক্ত বেদনাও তাঁর সংবেদী কলমটিকে, তাঁর কলমের কথক-সুরটিকে স্তব্ধ করতে পারেনি। লিখেছেন কম। ‘সৌদামিনীর দিনকাল’ নামে তাঁর গল্পগ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি ও পত্র-পত্রিকার পাতা থেকে সযত্ন সম্পাদনায় গ্রন্থনা করা হলো ‘সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ’ । দারিদ্র্য, অসুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকৃতি জীবৎকালে তো বটেই, মৃত্যুর পরেও সমরের পিছু ছাড়েনি(অকালপ্রয়াণ ২০০২ সালে)। এ কাজ ছিল আমাদের প্রজন্মান্তরের দায়।

সুপ্রকাশের প্রথম থেকেই লক্ষ্য, আলোকবৃত্তের বিপ্রতীপে থাকা বিষয়, মানুষ ও সমাজের স্বতঃশ্চল অন্তঃপ্রক্রিয়ায় এই যে আমাদের বর্তমান সংস্কৃতির অবয়ব— তার ধূলিধূসর ইতিহাস ও তার নেপথ্য কারিগরদের কথা তুলে আনা—যাঁদের কথা কোনো ইতিহাস বইতে লেখা থাকে না। যাঁদের কৃতিকে ইচ্ছাকৃত তাচ্ছিল্যে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়, যাঁদের পরিকল্পনামাফিক বাইরে রাখা হয় রশ্মিকেন্দ্রের— অথচ যাঁদের  শ্রম-মেধা-আত্মত্যাগকে আত্মসাৎ করেই মিথ্যে মেকাপে গড়ে তোলা হয় আমাদের সংস্কৃতির বৈভব— তাঁদের কথা বলাই সুপ্রকাশের স্বনির্বাচিত দায়।

সুপ্রকাশের প্রকৃত লক্ষ্য-মোক্ষ অনুধাবনে তার পুস্তক-তালিকাটি সহায়ক হতে পারে।

বাহুল্য হলেও উল্লেখ করা প্রয়োজন, সুপ্রকাশ ছাপাখানা বা পরিবেশক নয়। বই ছাপা, বাঁধাই, পরিবেশনা আর বিপণন বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, সেটাই একটা প্রকাশনার চরিত্র হওয়া উচিত। সুপ্রকাশ সে অর্থেই চরিত্রগত দিক থেকে একটি প্রকাশনা। এবং সুপ্রকাশ মনে রাখে—

কোনো শিল্পের সমস্যা শুধু আঙ্গিকের বা বহনযোগ্যতার নয়, মূল প্রশ্নটা মতাদর্শ ভিত্তিক সংগঠিত চলমানতার।

(— নদীয়া জেলার নাট্যচর্চা/সুপ্রকাশ)